সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৩:১৮ পূর্বাহ্ন

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রাজনীতি!

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রাজনীতি!

পবিত্র সরকার:

কী কপাল করে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আপনাকে সবাই পকেটে পুরে নেয়। নানা সাইজের পকেট। তার পরে পকেট থেকে বের করে করে দেখায়: ‘আও জি, দেখো জি, ইয়ে মেরা গুরুদেব হ্যায়।’ এ দল বলে, ‘তুমি আমার’; ও দল বলে, ‘আমার’। আপনাকে কাটে, বাদ দেয়, কিছুটা লুকায়, কিছুটা ফেলে দেয়, আর আপনার এক খাবলা তুলে নিয়ে লাফাতে থাকে, ‘আমার আমার’! ‘আমার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে কেমন ফটো তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ ফেসবুকে দেওয়ার মতো করে, দ্যাখ সবাই।’ ‘খবরদার তোরা আর কেউ রবীন্দ্রনাথের নাম নিতে পারবি না। আমার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমি যা খুশি করব-কাটব, কুটব, খিচুড়ি বানাব!’

২৪ ডিসেম্বর ২০২০ বিশ্বভারতী একশ বছরে পড়েছে। তাই বিশ্বভারতীর কাছে একটি ভিডিও বার্তায় ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুজরাটের দীর্ঘদিনের ভাব-ভালোবাসার কথা বলেছেন। কথাগুলো কিন্তু মিথ্যা নয়, ভুলও নয়। হ্যাঁ, ভারতের কোনো প্রদেশ যদি, বাঙালিদের পরেই, রবীন্দ্রনাথকে, হয়তো বা বাংলা সাহিত্যকে ভালোবেসে থাকে তা গুজরাট।

শুধু মহাত্মা গান্ধী নন। গুরুদয়াল মল্লিক, উমাশঙ্কর যোশী থেকে শুরু করে গুজরাটের বহু খ্যাত-অখ্যাত নাগরিক রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসেছেন, শান্তিনিকেতনকে সাহায্য করেছেন নানাভাবে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পারিবারিক যোগও তৈরি হয়েছিল গুজরাটের। এমনকি ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ গুজরাটি সাহিত্য সম্মেলনেরও সভাপতিত্ব করেছিলেন আহমদাবাদে।

কিন্তু তাতে কী হলো? এ প্রশ্নটা বা প্রশ্নগুলো কি এড়ানো যাবে যে, এমন রবীন্দ্রভক্ত, বাংলা সাহিত্যভক্ত প্রদেশ গুজরাটে ১৯০-এ ভয়াবহ মুসলমানবিরোধী দাঙ্গা হলো কেন? কেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (ঘটনাচক্রে এখন দেশের উজির-এ-আজম) শ্রী নরেন্দ্র মোদিকেই আবেদন জানাতে হয় রাজধর্ম পালনের জন্য, কেন এখনকার কেন্দ্রীয় সরকারের নানা ক্ষমতাবান পদস্থ গুজরাটি মন্ত্রীর নাম তাতে জড়িয়ে যায়, তাদের নামে এই বিষয়ে মামলা হয়?

কেন এবারে দিল্লির দাঙ্গায় উসকানিদাতা হিসাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের নাম উঠে পড়ে? ইতিহাসের একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতো, সাইনবোর্ডে লিখে ঝোলানোর মতো সত্যও যে কী সব ভয়ংকর প্রশ্ন আমন্ত্রণ করতে পারে, কে ভাবতে পেরেছিল? রবীন্দ্রনাথ পারেননি, হয়তো সেই গুজরাটও পারেনি যে গুজরাট রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসেছিল।

কবে থেকে গান্ধীজির বা রবীন্দ্রনাথের গুজরাটকে দখল করল হিন্দুত্ববাদীরা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা গবেষণা করুন। আমি ঐতিহাসিক নই, আমি শুধু বর্তমানের দিকে তাকাই, আর ভাবি, হঠাৎ এত রবীন্দ্রহুল্লোড় কেন রাজনীতির সওদাগরদের? সেটা কি পশ্চিম বাংলার আসন্ন ২০২১-এর নির্বাচনের কথা ভেবে, বাঙালির হৃদয় এবং একইসঙ্গে পশ্চিম বাংলার মসনদ দখল করার সুচতুর পরিকল্পনা থেকে?

এ ছয়-সাত বছরে তো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত মাখোমাখো কথা কেন্দ্রীয় কর্তাদের মুখে শুনিনি! বরং হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত ধ্বজাধারীরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানাভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা রবীন্দ্রনাথের জনগণমনকে বাদ দিয়ে বন্দেমাতরমকে জাতীয় সংগীত করতে চেয়েছেন, না হয় রবীন্দ্রনাথের জনগণমন-এর কথা বদলে দিতে চেয়েছেন (সুব্রহ্মণ্যম্ স্বামী এর এক সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র), রবীন্দ্রনাথকে উগ্র জাতীয়তাবাদী বানিয়েছেন, ভুলেই গেছেন যে উনিশ শতকের শেষেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে’, তথাকথিত Nationalism-এর চিরশত্রু ছিলেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা বলতে কী বোঝেন তারা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ বক্তৃতা ‘সভ্যতার সংকটে’ বলেছিলেন, ‘মানুষের উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ?’ কেন জীবনের শেষ গানে ভরসা করেন মুক্ত চৈতন্যে উদ্বুদ্ধ যে, সমগ্র মানুষ, নিখাদ মানবতা-হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, বৌদ্ধ নয়, খ্রিষ্টান নয়, সাদা নয়, কালো নয়, বাদামি বা হলুদ নয়-শুদ্ধ পরিচয়হীন মানুষ-রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘মনের মানুষ’ বা The Essential Man-সেই এসে সভ্যতার সংকট কাটাবে, কোনো ঈশ্বর নয়। সেই গান হলো ‘ওই মহামানব আসে।’

এই সাদা সত্যটা কি বাঙালি ভোটাররা বুঝতে পারবে না? বুঝতে পারবে না যে, এটা একটা আন্তরিকতাহীন কৌশল মাত্র? এই পূজার ছলে ভুলে থাকা, এই ‘স্তবের বাণীর আড়াল টানি’ তাকে ঢেকে ফেলা সবাই মসৃণভাবে চালিয়ে যাবেন রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ! আপনার অসহায়তা দেখে আমাদের কষ্ট হয়। আপনি গুজরাটেরসহ নানা দেশের নেতানেত্রীসুদ্ধ কত ‘জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’ অর্থাৎ, তাদের পকেটস্থ, সবাই মুখে মুখে আপনাকে ‘কোট’ করে আমাদের চমকে দিতে চান। কিন্তু আপনি আদভানিজির সামনে দাঁড়িয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার দৃশ্য উপভোগ (তার সঙ্গে ফাউ শ্রীমতী উমা ভারতীর খুশিতে তার কাঁধে উঠে পড়ার চেষ্টা) রোধ করতে পারেন না, বা গুজরাটের ১৯০২ সালের দাঙ্গা রোধ করতে পারেন না। আপনি ‘চণ্ডালিকা’ লিখে দেশকে কাঁদান, শ্রীমতী বৈজয়ন্তীমালা, মৃদুলা সারাভাই (তিনিও গুজরাটের), এমনকি, আমার স্মৃতি যদি আমাকে লেঙ্গি না মেরে থাকে, বিজেপির বর্তমান এক সংসদ সদস্য শ্রীমতী হেমা মালিনী পর্যন্ত তার পরিবেশনা করে আমাদের মুগ্ধ, মুহ্যমান করে দেন; কিন্তু ওই গুজরাটে অহরহ দলিত নির্যাতন চলতেই থাকে।

গরবা নাচের আসর লুকিয়ে দেখছিল বলে কাউকে মারা হয়, বাহারি গোঁফ রেখেছে বলে কাউকে মনের সুখে পেটানো আর গোঁফ কামিয়ে দেওয়া হয়। উত্তরে, দক্ষিণে সর্বত্র জলের কল থেকে জল তুলেছে বলে তাদের (আবার ‘মনের সুখে’) পেটানো চলে। প্রধানমন্ত্রীজি, আপনার শাসিত এবং সুখী ভারতে ‘লাভ জেহাদ’ নামে একটি ভয়াবহ ধারণা আপনার অনুগামীদের (নাকি আপনি তাদের অনুগামী-কে কোন্টা বোঝা মুশকিল!); অথচ যে রবীন্দ্রনাথের নাম না করে ইদানীং আপনি জল খাচ্ছেন না বা আপনার ভাত হজম হচ্ছে না, সেই রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘মুসলমানির গল্প’ কি আপনি পড়েছেন? যেখানে মুসলমান ছেলের সঙ্গে হিন্দু কন্যার বিয়ে দিতে তার এতটুকু হাত কাঁপেনি; বরং ব্যাপরটাকে সস্নেহে অনুমোদন করেছেন। আর আমি অনুমোদন বলছি কেন, তিনি নিজেই তো ব্যাপারটা ঘটিয়েছেন। মধ্যযুগের রাজপুত সমাজ না হয় বাধ্য হয়ে মোগল-পাঠানদের ঘরে মেয়ে দিয়েছিল, তবু সেই প্রাতঃস্মরণীয়া মহিলাদের মধ্যে পতিব্রতা স্ত্রীর অভাব ছিল না, রবীন্দ্রনাথও সে সম্বন্ধে লিখেছেন, তা কি আপনি জানেন?

ও রবীন্দ্রনাথ, আমি জানি আপনি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে যেমন, তেমনি সংকীর্ণ জাতীয়তাকে ‘আত্মনির্ভরতা’ নাম দেওয়ার ধাষ্টামোকে ঘেন্না করতেন, আপনি দেশের মাটিতে মাথা নুইয়েছেন; কিন্তু তাতে যে ‘বিশ্বময়ীর, বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা’, তা লক্ষ করতে ভোলেননি। কিন্তু কী করে বন্ধ করা যায় পশ্চিম বাংলার আর বাঙালির জন্য ভাব-ভালোবাসা জানিয়ে এখানকার নির্বাচনের আগে এই খ্যাপার মতো অশিক্ষিত মাতামাতি? বিশ্বভারতীর একশ বছরে কোথায় তার জন্য অগ্রগতির নতুন দিগন্ত মেলে ধরবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, না বক্তৃতা হলো তার প্রদেশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কী যোগ তাই নিয়ে। আপনার কি এসব ধাষ্টামো বন্ধ করার ক্ষমতাটুকুও আছে?

নেই তা জানি। আপনি তবু আমাদের দিনরাত্রি এমন আকুল করে রাখেন কী করে, তাই ভাবি!

পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877